বন্ধ চোখে চিন্তিত খুব
হাঁটছ পথে একা,
বামের মোড়ে গেলেই পাবে
সুন্দরীদের দেখা।
বন্ধু তুমি পাড় হয়ো না
তোমার সীমারেখা।
২.প্রেম দেবতা কৃষ্ণ ছিল
আমি হলাম গাধা
বিয়ে করে বৌ পেয়েছি
পেলাম নাতো রাধা।
নগণ্য এক শব্দ শ্রমিক
তাই পড়েছি ধাঁধায়
অপরাধের সংজ্ঞারা সব
শব্দবিহীন কাঁদায়।
এ রকম শব্দবিহীন কাঁদার প্রেমের কবিতা লিখে যিনি ইতিমধ্যে দেশে ও বিদেশে স্বনামে, স্বকীয়তায় নিজেকে উপস্হাপনা করেছেন তিনি খালেদ সরফুদ্দীন। তাঁর সাহিত্যকর্মের বিশাল অংশ জুড়ে আছে প্রেম-ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের বহুমাত্রিক রূপের বন্দনা। খালেদ সরফুদ্দীন তাই প্রেমের কবি। তবে শুধু এই পরিচয়ে যদি তাঁকে আমরা ধরে রাখি তাহলে তাঁর সৃজনকর্মের যথাযথ বিচার হয় না। কারণ তাঁর সৃজনশীলতার ক্ষেত্র বহুদূর বিস্তৃত। লাল নীল দীপাবলির আরেক রূপ, আরেক আঙ্গিক, লোকসাহিত্যের অহংকার ছড়াকবিতায়ও রয়েছে তাঁর স্বাচ্ছন্দ ও সাবলীল পদচারণা। এক্ষেত্রে সহজিয়া প্রকাশে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তবে তাঁর ছড়ার বিষয়বস্তু, বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন, রূপকল্প সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তথা আলাদা। ঘুমপাড়ানিয়া ছড়ার যে অনুষঙ্গ চাঁদ, ফুল, পাখি, পুতুল, রূপকথার ভূত-প্রেত, দত্যি-দানোর মতো অনুষঙ্গগুলো সযত্নে এড়িয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন দেশ, মাটি ও মানুষকে। মাটির সোঁদাঘ্রাণ, সমাজমনস্কতা ও রাজনীতি এই তিনের রসায়নে মিষ্টি ছড়া বুননে তিনি পরিচয় দিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতার–
আমি এখন দূরে থাকি
অনেক অনেক দূরে,
স্মৃতির সবই পড়ে আছে
চাটগাঁ শহর জুড়ে,
আজাদী আর পূর্বকোণে
মনটা বেড়ায় ঘুরে,
বন্ধুরা সব কেমন আছো
চাটগাঁ শহর জুড়ে?
লালদিঘিরই সবুজ ঘাসে
ফুলসুপারি গাছের পাশে
মোমেন স্যারের ফুলকি মেলায়
সবাই মিলে বিকেল বেলায়
হাটি হাটি পা পা করে
চাটগাঁ হলো ছড়ার শহর
কবিতা ও গল্প নিয়ে
গর্ব কিছু করার শহর।
সেই শহরের আমি
চোখ দুটোকে একটু বুজে
হঠাৎ করে থামি,
চাটগাঁ শহর বিশ্ব বুকে
সবার চেয়ে দামি।
এভাবে খালেদ সরফুদ্দীন কবিতা ও ছড়ার রাজ্যে নিরন্তর, নিরবচ্ছিন্ন শ্রম, মেধা ও মননের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে নিজের একটি স্বতন্ত্র, স্বকীয় আসন তৈরি করেছেন।
দুই
খালেদ সরফুদ্দীন ১৯৬৪ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের দক্ষিণ সলিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আলহাজ্ব শেখ নুরুল আনোয়ার। মায়ের নাম চৌধুরি সখিনা বেগম। পেশায় চিকিৎসক বাবার ছয় সন্তানের মধ্যে খালেদ সরফুদ্দীন হলেন সবার বড়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর পাস এই লেখকের স্ত্রীর নাম কোহিনূর আকতার। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সুখের গৃহকোণ। তাঁদের বড় সন্তান মেয়ে। তার নাম পারাপার খালেদ মেধা আর ছেলের নাম চিশতি আলি খালেদ আদি। আমেরিকার নিউইয়র্ক প্রবাসী এই কবি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক USBanglanews24.com এর নির্বাহী সম্পাদক। উল্লেখ্য, এই অনলাইন দৈনিকটি প্রতিমাসে একবার হার্ড পেপারে ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশিত একমাত্র মাসিক। এছাড়া তিনি www.postcard.com এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
চট্টগ্রামের বেশিরভাগ লেখকের মতোই খালেদ সরফুদ্দীন-এর প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের পাঠকপ্রিয় দৈনিক ‘আজাদী ‘র আগামীদের আসরে। তাঁর লেখালেখি জীবনের প্রথমদিকে তিনি সরফুদ্দিন খালেদ জসীম নামে লিখতেন। এই নামে তিনি ‘পায়রা’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। এই ম্যাগাজিনের প্রথম দিককার কয়েকটি সংখ্যায় ছড়াকবিতার চেয়ে বড়দের কবিতা ও গল্প বেশ গোছালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আজকের প্রতিষ্ঠিত কবিসাহিত্যিকদের অনেকের লেখাই ঐ ম্যাগাজিনে সযত্নে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি সংখ্যা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় কবি শামসুর রাহমান, খালেদা এদিব চৌধুরীর পাশাপাশি পত্রস্হ হয়েছে ‘অবরুদ্ধ মানচিত্রে’র কবি মিনার মনসুর, লড়াকু ছড়াকার আসলাম সানী, কবি জাফর ওয়াজেদ প্রমুখ এর লেখা। এই বিষয়গুলো অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তবে খালেদ সরফুদ্দীন- এর ঝোঁক তথা কবি প্রতিভা অন্বেষণে এটি যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে আমার ধারণা। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে আমরা যদি খালেদ সরফুদ্দীনকে শুধুমাত্র কবি হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে তাঁর অন্য একটি জগত আলোর বাহিরে থেকে যায়। আবার যদি শুধুমাত্র নান্দনিক ভুবনকে গুরত্ব দিই তাতে হয় তাঁর ওপর অসম্পূর্ণ আলোকপাত। কারণ লেখালেখির বাইরে তিনি এমন একটি জগতে তাঁর মেধা, মনন ও শ্রম দিয়েছেন সেটি সরাসরি সাহিত্য না হলেও শিশুদের মনোরঞ্জনেরই একটি অংশ। আর তা হলো শিশুকিশোরদের মানসিক বিকাশে তিনি রেখেছেন অসামান্য অবদান নানা শিশু সংগঠনের মাধ্যমে। সিটি কলেজে (বর্তমান সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) অধ্যায়নকালীন তিনি স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি লেখালেখি ও সম্পাদনাকর্মে যুগপৎ কাজ করে গেছেন। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাকালে তিনি অনেক বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এরপরও তিনি ছিলেন আপসহীন ও আজন্ম লড়াকু। একবার ‘পায়রা’ ম্যাগাজিনের একটা সংখ্যা করতে গিয়ে প্রচ্ছদ ছাপতে গিয়ে ঘাবড়ে যায় ছাপাখানা কর্তৃক। পরে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম না দেওয়ার শর্তে ম্যাগাজিনটি ছাপা হয়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছিল এই প্রচ্ছদটি। কাকতাড়ুয়ার আদলে মাথায় চাঁনতারা দিয়ে আঁকা সচেতন পাঠকের কাছে নন্দিত এই প্রচ্ছদটির প্রচ্ছদ করেছিলেন ঐ সময়ের খ্যাতনামা প্রচ্ছদশিল্পী সাফায়াত খান।
তিন
খালেদ সরফুদ্দীন লেখালেখির পাশাপাশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন নানা শিশুকিশোর সংগঠনে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রথম শিশুকিশোর সংগঠন শাপলা কুঁড়ির আসর, চট্টগ্রাম জেলা শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কেন্দ্রীয় শাপলা কুঁড়ির আসরেরও ছিলেন অন্যতম নীতিনির্ধারক। মুক্ত মনের মানুষ হিসেবে শিশুদের মানসজগত আলোকিত করতে তিনি খেলাঘর, চাঁদের হাট, কচিকাঁচার মেলার সঙ্গেও জড়িত থেকে কাজ করে গেছেন। চট্টগ্রামে শাপলা কুঁড়ির আসরের নতুন নতুন শাখা গঠনে ছিল তাঁর অনন্য ভূমিকা। এসময়ে তিনি নিজেকে উন্নীত করেছেন একজন দক্ষ শিশু সংগঠক হিসেবে। সর্বশেষ তিনি জড়িত হন কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশুকিশোর মেলার সঙ্গে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে কলম্বাসের দেশ আমেরিকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধু শিশুকিশোর মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে শিশুকিশোরদের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তুলে ধরেছেন।
১৯৭৯ সালে খালেদ সরফুদ্দীন-এর লেখক জীবনের সূচনা হলেও তিনি মলাটের ভেতরে এসেছেন অনেক দেরিতে। তবে কথাও ঠিক যে, তাঁর লেখালেখির সময়কাল দীর্ঘ চার দশক পার হলেও তাঁর নান্দনিক ভুবনে বিচরণ, চর্চা ও অনুশীলনে ছিল না ধারাবাহিকতা । ছিল ছন্দপতন। বিরাট বিরতি। এই বিরতি বা ছন্দপতনের নেপথ্যে যে কোনো কারণ ছিল না তা কিন্তু নয়। এর কারণ হিসেবে আমরা যতটুকু জানি তার মধ্যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকতাও কোনো কোনোভাবে দায়ি। কোনো এক অভিমানের কারণে লেখক দীর্ঘদিন লেখালেখি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন বা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রচণ্ড অভিমানি এই লেখককে আবার মননশীল জগতে ফিরিয়ে আনেন নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যকার আবু সাঈদ রতন। এই সজ্জন ব্যক্তির নিরন্তর তাগিদ ও অদম্য ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণায় খালেদ সরফুদ্দীন আবার নিয়মিত হন সাহিত্যের ভুবনে। সেই থেকে তিনি লিখে চলেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একটি যৌথ কাব্যগ্রন্হসহ নয়টি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্হগুলো হলো :
১. আগামী বৈশাখে রাঙাবো তোমায়
(কাব্যগ্রন্হ,২০১৩)
২. তোমার মুখে ফুল চন্দন তুমি আমার আমি (কাব্যগ্রন্হ, ২০১৪)
৩. ফুলেল স্বাক্ষী ফুলের বাগানে
( কাব্যগ্রন্হ,২০১৫)
৪. বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি
( কাব্যগ্রন্হ,২০১৬)
৫. স্বপ্নশিকারিদের অরণ্যবিহার
(যৌথ কাব্যগ্রন্হ, ২০১৬)
৬. কুটুম কুটুম (ছড়াগ্রন্হ,২০১৭)
৭. বশীকরণ তাবিজ কথা ( কাব্যগ্রন্হ, ২০১৮)
৮. খাসকথা ( ছড়াগ্রন্হ, ২০১৯) এবং
৯. নীল ছায়া ( অণু উপন্যাস, ২০২০)
চার
উপর্যুক্ত গ্রন্হগুলো এক দৃষ্টিতে দেখলে আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত হয় খালেদ সরফুদ্দীন মূলত কবি। প্রেমের কবি। প্রেমময় ভুবনের কবি। তাঁর নিশ্বাসে আর বিশ্বাসে একাকার হয়ে আছে প্রেম।তাঁর গ্রন্হের নামগুলোই আমাদের এই প্রতীতির পেছনে যথেষ্ট সহায়ক। আগামী বৈশাখে রাঙাবো তোমায়, তোমার মুখে ফুল চন্দন তুমি আমার আমি, ফুলেল সাক্ষী ফুলের বাগানে, বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি এই নামগুলোর মাঝেই ফুটে উঠেছে তাঁর প্রেমের স্বরূপ। তিনি অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কবি। তাঁর কবিতায় পদ্যের আঙ্গিকে তিনি একটি প্রেমময় ভুবনে স্বাচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন বা করার প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর এই প্রেম দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, স্ত্রী-সন্তান-বন্ধুদের প্রতি। তাঁর কবিতায় দ্রোহ আছে। প্রতিবাদ আছে। অচলায়তন ভাঙার প্রয়াস আছে। জন্মভূমির প্রতি আছে দায়িত্ববোধ ও অপার দরদ।
আমাদের কবিরা যেখানে কবিতাকে দুর্বোধ্য, ভাষার সহজিয়া প্রকাশের বদলে জটিল-কুটিল করে তোলেন সেখানে খালেদ সরফুদ্দীনের কাব্য-ভাষা ঝরনার মতো। আর আকারে তা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম। মেদহীন ঝরঝরে তাঁর কবিতার শরীর। তিনি ভালো করেই বুঝেন আজকের এই ডিজিটের যুগে মেদবহুল দীর্ঘ কবিতা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময় মানুষের নেই। আর কম পঙক্তিমালায় যদি বেশি সুবাস ছড়ানো যায় তাতেই পাঠক লুফে নেয় বেশি। তাই তাঁর গ্রন্হিত কবিতার শরীর আসমানী বা গোলাপীদের মতো বেশ ক্ষীণকায় –তবে তার ঝাঁঝ কাইন্যা মরিচের মতো। দু’ একটা পঙক্তি তুলে আনলে বিষয়টি বুঝতে আরও সহজ হবে–
১. কিছু কিছু কথা আছে বলে দিতে হয়
কিছু কিছু কান আছে মলে দিতে হয়।
(বশীকরণ তাবিজ কথা, পৃষ্ঠা-০৭)
২. সত্যের আশ্রয়ে মিথ্যারা বড় হয়
মানুষের ইদানিং সত্যকে ভয়।
(ফুলেল সাক্ষী ফুলের বাগানে, পৃষ্ঠা -২০)
৩. হাজার হাজার প্রশ্ন শুধু / উত্তর নেই যে দিবস
শ্রমের সাথে লুকোচুরি / সুবাসবিহীন মে দিবস।
(তোমার মুখে ফুল চন্দন তুমি আমার আমি, পৃষ্ঠা-১৯)
৪. ভাল্লাগে না হিসেব নিকেশ / মন থাকে না মনে
এই গ্রহতে আটকে আছি নিজের প্রয়োজনে।
(আগামী বৈশাখে রাঙাবো তোমায়, পৃষ্ঠা -১৮)
৫. কবিদের মেমোরি কত গিগাবাইট
কবিতা কি দিতে পারে অনিয়ম টাইট।
( বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি, পৃষ্ঠা -২৩) এভাবে প্রবাদসম অসংখ্য পঙক্তির উদ্ধৃতি দেওয়া যায়, যা পাঠককে দিতে পারে সমান্তরালভাবে ঝাঁঝ আর ভাবনার অতল উপাদান।
পাঁচ
খালেদ সরফুদ্দীনের কবিতায় আছে প্রেম। আছে সমাজমনস্কতা, আছে রাজনীতির নানা অলিগলির কথা। আছে দেশ, মাটি ও মানুষের কথা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে একজন ‘তুমি’। তাঁর সিংহভাগ কবিতায় আমরা একজন ‘তুমি’র উপস্হিতি লক্ষ্য করি। এই তুমিটা কে? এই তুমি’কে ঘিরেই খালেদ সরফুদ্দীন-এর সকাল-বিকাল-সাঁঝ-রাত্রি। কবির চোখে এই তুমি বড়ই সুন্দর, অতুল, অনন্য। তাই তিনি পরম আত্মবিশ্বাস লিখেন–
যেখানে শুধু ভালোবাসা আছে
ভুলগুলো সব নির্ভুল খাতে,
আমি তোমাকে নিয়ে যাব আজ
ভালোবাসা ভরা স্বপ্নের সাথে।
ফুলেল সাক্ষী ফুলের বাগানে
গাছগুলো দোলে বাতাসের গানে,
তোমাকে দেখে ফুলগুলো মলিন
তুমি সুন্দর তুমি অমলিন।
(ফুলেল সাক্ষী ফুলের বাগানে, পৃষ্ঠা-০৫)
এই ‘সুন্দর তুমি’র জন্য প্রায়ই মন উচাটন করে কবির। তিনি তাঁর এই অস্থিরতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে–
তোমার জন্য মন উচাটন
স্বরবৃত্ত ছন্দে
ঘুমের ওষুধ খুঁজি আমি
তোমার চুলের গন্ধে।
তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাব
গ্রীষ্মকালের বন্ধে।
( তোমার মুখে ফুল চন্দন তুমি আমার আমি, পৃষ্ঠা-৪৫)
স্বরবৃত্ত ছন্দ ছড়ার ছন্দ। এই ছন্দ বড় দুরন্ত, বড় গতিময়। আর কবির এই স্বরবৃত্ত ছন্দের মতন তাঁর ‘তুমি’কে ভালোবাসে। তাই আমরা মনে করতে পারি কবির ‘তুমি’ কোনো ভালোবাসার মানুষ, ভালোলাগার মানুষ। কবি তার চুলের গন্ধে বিভোর হন, তাকে নিয়ে গ্রীষ্মকালের ছুটির সময় বেড়াবার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু কবি যখন এই ‘তুমি’র স্বরূপ স্পষ্ট করেন তখন আমরা চমকিত হই, আবিষ্কার করি ‘তুমি’র আরেক রূপ। এই তুমি কোনো মানব-মানবী নয়–তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশ। নিজ জন্মভূমি থেকে সাত সমুদ্র তের নদী দূরে থেকে তিনি দেশকে কতটা ভালোবাসেন, কতটা নাড়ির বন্ধন অনুভব করেন তারই প্রত্যক্ষ প্রকাশ নিচের পঙক্তিমালা–
ভোর বিহানে আমার ফোনের অপেক্ষাতে থাকো,
মিষ্টি কথার ফুলঝুরিতে কেমন মায়ায় রাখো?
তোমার মুখে ফুল চন্দন তুমি আমার আমি
তাইতো আমি তোমার সাথে মন খেলাতে নামি।
তোমার কপাল লালটিপেতে বাংলাদেশের মুখ
তুমিই আমায় দিতে পারো ভালোবাসার সুখ।
(তোমার মুখে ফুল চন্দন তুমি আমার আমি, পৃষ্ঠা ০৯)
কবি দেশের বাইরে থাকলেও দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তাঁর যে একটা দায় আছে তা তিনি কখনো ভুলে যান না। ফলে তাঁর ছড়া-কবিতায় উঠে এসেছে স্বদেশ-মাটি-মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ —
১. আমার ভাষাতে আমি কথা বলি
তোমার ভাষাতে তুমি,
ভিনদেশে এসে মনে পড়ে বেশি
জননী জন্মভূমি।
……………
খালি পায়ে এসো প্রভাতফেরিতে
ধীরে ধীরে সারি সারি,
বুকের কিনার শহিদ মিনার
একুশে ফেব্রুয়ারি।
(বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি, পৃষ্ঠা -৪৮)
২. বাবা আমায় কিছু কিছু স্বপ্ন দিয়ে গেছে
স্বপ্নগুলো আমি এখন জড়িয়ে থাকি,
ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে কাজের শেষে
অবসরে স্বপ্নদাতার স্বপ্নগুলো আঁকি।
স্বপ্ন ছিলো মানবতার পক্ষে থাকার
মিলেমিশে এক কাঠামোয় স্বপ্ন আঁকার।
স্বপ্নগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠি এবং নামি
আমার বাবা আমার কাছে অনেক অনেক দামি।
(বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি, পৃষ্ঠা -৪২)
ছয়
খালেদ সরফুদ্দীন-এর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো তিনি বন্ধুবৎসল। বন্ধুত্বের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে তিনি নানা চিত্রকল্পের মাধ্যমে এক মায়াবী ভুবন সৃজনে প্রয়াসী হয়েছেন। বন্ধুত্ব সম্পর্কে তাঁর ধ্যান, ধারনা ও পর্যবেক্ষণ তিনি গ্রন্হিত করেছেন আলাদা একটি কাব্যগ্রন্হে। নামও রেখেছেন সমান আকর্ষণীয় ও মনোহর। ‘বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি’ এই কাব্যগ্রন্হের প্রতিটা কবিতা বন্ধুকে নিয়ে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘man cannot live alone’. মানুষের একাকীত্বে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে একজন বন্ধু, যদি তেমন বন্ধু হয়। একজন মানুষ মা-বাবা, ভাই -বোন এমনকি স্ত্রী-র কাছে যা বলতে পারে না তা অনায়াসে, প্রাণ খুলে নির্ভরতার সঙ্গে বলতে পারে বন্ধুকে। লক্ষ্য করার বিষয় কী ও কি এর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবি একজন বন্ধুর কি কি গুণ থাকা দরকার তা বন্ধুদের জানা আছে কি না সেই প্রশ্ন ছুঁড়ে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
কবি খালেদ সরফুদ্দীন বন্ধু মানে খুঁজতে চষে বেড়িয়েছেন দেশ, প্রকৃতি, নির্সগ, জীবন-সংগ্রামের প্রতিটি পরতে। হৃদয়টা যাঁর আগরবাতির আধার তিনি তো সর্বত্র রতনই দেখবেন। তাই তো তিনি সোনালি রোদ, কানামাছি, ছায়াসুনিবিড় শান্ত পরিবেশ, সোনাভরা দেশ, হোলিখেলা, নকশিকাঁথা, কালবৈশাখী, নিকেল করা বিকেল, জোনাক পোকা, পূর্ণিমা রাত, ইষ্টি কুটুম, ঈদের জামাত, চি কুত কুত খেলার মতো সোনালি শৈশবের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন বন্ধুর মানে। যেমন, তাঁর কাছে বন্ধু মানে–
বন্ধু মানে বলতে পারা না বলা সব কথা,
বন্ধু জানে সবার প্রিয় প্রাণের স্বাধীনতা।
বন্ধু মানে বাংলাদেশের লাল সবুজের মুখ,
বন্ধু মানে স্বাধীনতায় গর্বে ভরা বুক।
(বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি, পৃষ্ঠা -১০)
শুধু তাই নয় রাজনীতির মতো কুটচালের মধ্যেও তিনি বন্ধুর রূপ উন্মোচন করেছেন–
বন্ধু মানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের রেল
বন্ধু মানে বিএনপিতে জামাত পিরীত ফেল।
আসমুদ্রহিমালয় চষে কবি ঠিকই তাঁর বন্ধু মানে কী বুঝেছেন এবং প্রকৃত বন্ধুর খোঁজ করে নিয়েছেন। আসলে পৃথিবীতে যে কোনো মানুষের সবচেয়ে প্রিয় স্হান হচ্ছে তাঁর ঘর এবং প্রিয় মানুষ ঘরনি। কবি তাই পরম বিশ্বাসে বলে উঠেন —
বন্ধু জানে বন্ধু আমার কোহিনুর আকতার
বন্ধু জানে সইতে পারে ভালোবাসার ভার।
(বন্ধু মানে কী বন্ধু জানে কি, পৃষ্ঠা -১৩)
সাত
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে মাটির সোঁদাঘ্রাণ, সমাজমনস্কতা ও রাজনীতি এই তিনের রসায়নে মিষ্টি মিষ্টি ছড়া বুননে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন খালেদ সরফুদ্দীন। তাঁর মঞ্চ কাঁপানো বেশ কিছু গণমুখি ছড়া এখনো ছড়াপ্রেমি মানুষের মুখে মুখে ফিরে। ছাত্র জীবনে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সুযোগ পেলেই তিনি একটি ছড়া ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করে শোনাতেন। দীর্ঘ ছড়াটির প্রথম চার লাইন এরকম–
হক মওলা হক
আমিই শুধু ভালো আছি
অন্য সবাই ঠগ,
হক মওলা হক।
তাঁর আর একটি দীর্ঘ ছড়ার নাম ‘লিলিভূত’। এই ছড়াটি ছোট ও বড়দের কাছে সমানভাবে আদৃত। এটি পাঠে ছোটরা পায় অপার আনন্দ আর বড়দের দেয় ভাবনার অফুরান উপাদান। লিলিভূতের আদলে তিনি সমাজের নানা অসঙ্গতি ও ব্যক্তিবিশেষের স্বরূপ তুলে ধরেছেন এই ছড়ায়–
লিলিভূত বাস করে জ্যাকসন পাড়াতে
পেতনিরা পিটিয়েছে মন রোগ সারাতে
মার খেয়ে ব্যথা খুব পারছে না দাঁড়াতে
লিলিভূত শিখে নেবে কুংফু ও কারাতে।
……..
ভয়ে আছি লিলিভূত কবে দেয় খামচি
চিন্তার সূত্রেই হেঁটে হেঁটে ঘামছি
জ্যাকসন পাড়া থেকে শুধু নিচে নামচি
শুধু নিচে নামচি… শুধু নিচে নামচি।
( কুটুম কুটুম, পৃষ্ঠা -১০-১১)
খালেদ সরফুদ্দীন কবিতায় যেমন ছড়ায়ও তেমন কুশলি। তাঁর ছড়ার চিত্রকল্প যেমন অগানুগতিক, তেমনি নির্মিতিতেও রয়েছে নিজস্বতা। সুদূর প্রবাসে থেকেও দেশের রাজনীতি ও উন্নয়ন নিয়ে তিনি সচেতন ও আশাবাদী । এ বিষয়ে তিনি লিখেন,
পিতা তুমি শুনতে কি পাও
তৃণমূলের বিলাপ?
কান্না জলে জমাট বাঁধা
জড়িয়ে তোমার গিলাপ।
একাডেমিক চিন্তাগুলো
শোক দিবসে ফুটুক,
জয় বাংলার জয়ধ্বনি
ভেসে ভেসে উঠুক।
(কুটুম কুটুম, পৃষ্ঠা -২৬)
কিংবা,
অভাবীদের মনের খবর
শেখ হাসিনা জানে
বাংলাদেশ আজ সম্মানিত
শেখ হাসিনার দানে।
দেশ প্রেমের ভালোবাসায়
ধন্য সবাই ধন্য,
এক আকাশের তারার মেলা
শেখ হাসিনার জন্য।
(কুটুম কুটুম, পৃষ্ঠা -৩৯)
খালেদ সরফুদ্দীন দেশপ্রেমমূলক ছড়া যেমন লিখছেন, সমানতালে লিখেছেন সমাজচেতনার ছড়া। আমাদের মহোত্তম অর্জনগুলোও তাঁর ছড়ার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে বার বার। ছড়ার স্বাচ্ছন্দ গতি স্বরবৃত্তের রেলে চড়ে তিনি নানা ননসেন্স, অদ্ভুত ছড়ার ভুবনেও বিচরণ করেছেন অবলীলায়। ছড়াসাহিত্যের ভুবনে তাঁর এই অবাধ বিচরণকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের সবচে’ পাঠকপ্রিয় ছড়াশিল্পী লুৎফর রহমান রিটন খালেদ সরফুদ্দীনকে তাঁর ছড়াবন্ধু আখ্যায়িত করে লিখেছেন, ‘ সব ধরনের ছড়ার প্রতিই বিপুল আগ্রহ খালেদের। আর তাই শিশুতোষ কিংবা বয়স্কজনপাঠ্য ছড়া রচনায় নিমগ্ন দেখি তাকে। আমাদের ছড়ার অঙ্গনটিকে নানান বর্ণের পত্র-পল্লব আর পুষ্প সমাহারে মুখরিত করে রাখতে চায় সে। আর তাই সে ছড়া লেখে নিয়মিত। ছোটদের। বড়দের। শিশুদের অনিন্দ্যসুন্দর ভুবনের বর্ণাঢ্য কর্মকাণ্ড এবং বড়দের জটিল ও সমস্যাসংকুল ভুবনের বাস্তব চিত্র অংকনে বরাবরই দক্ষতার পরিচয় দেন খালেদ সরফুদ্দীন। আমি তার ছড়ার একজন অনুরাগী পাঠক।… আমাদের ছড়ার আকাশে খালেদের ছড়াগুলো তারা হয়ে ফুটুক। ওর ছড়ার দ্যুতিতে আলোকিত হয়ে উঠুক আমাদের ছড়ার ভুবনটি।’ আর তাই খালেদ সরফুদ্দীন সুন্দর সমাজ ও প্রেমময় ভুবন প্রত্যাশী এক স্বাপ্নিক কবি ও ছড়াকার।
-এমরান চৌধুরী
কলাম লেখক, গল্পকার, কবি ও শিশু সাহিত্যিক ।